বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় কি শুধুই একটি বিদ্যালয়?

বিন্দু বাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় কি শুধুই একটি বিদ্যালয়?

১৮৮০ ইং সালে ব্রিটিশ যুগে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের নামে গ্রাহাম ইংলিশ হাই স্কুল স্থাপন করা হয়। প্রথমে স্কুলটি সে সময় মাইনর স্কুল ছিলো। স্কুলটি পরিচালনার ভার অর্পিত হয়েছিলো ধনবাড়ির জমিদার নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর উপর। তিনি স্কুলটি নিজ অনুদানে দুই বৎসর পরিচালনা করেছিলেন।


এরপর ১৮৮২ ইং সালে সন্তোষ জমিদার রানী বিন্দু বাসিনী রায় চৌধুরানী স্কুলটির দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং নিজ নামে বিদ্যালয়টির নামকরণ করেন। সে বৎসরেই তিনি বিন্দু বাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে নিজ জমিদারি হতে ১৯১০ ইং সাল পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা করে যান। এরপর তিনি ঐ বৎসরই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন এবং তাঁর ট্রাস্টের শতাধিক সদস্যের মধ্যে তাঁর দুই ছেলে প্রমথ নাথ রায় চৌধুরী ও স্যার মম্মথ নাথ রায় চৌধুরীও ছিলেন। তাঁদের মাতা বিন্দু বাসিনী রায় চৌধুরানীর মৃত্যুর পর তাঁরা বালক বিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরীসহ ভবন নির্মাণ করেন। সে থেকেই দুই ছেলে বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। তারপর বহু বৎসর পর ১৯৭০ ইং সালে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করা হয়।


আজ আমি লিখছি ঐতিহাসিক বিন্দু বাসিনী বিদ্যালয়কে নিয়ে। আমি ঐতিহাসিক শব্দটি জুড়ে দিলাম এই কারণে যে স্বাধীনতা যুদ্ধলগ্নে এই বিদ্যালয়ের মাঠ হতেই এই বিদ্যালয়ের ও অন্যান্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ ও বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষসহ অস্র হাতে নিয়ে অকতুভয় বীর সেনানীর মতো দেশ স্বাধীনের জন্যে ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন। আবার টাঙ্গাইলকে হানাদারমুক্ত করে তথা স্বাধীন দেশে সেদিনের এই উত্তাল বিদ্যালয়ের মাঠেই অস্র সমর্পণ করেছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম এর নেতৃত্বে সেদিনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদতলে। সেদিন মুহূর্মুহু করতালির মাধ্যমে বাঁধভাঙ্গা জনতার ঢল এই বিদ্যালয় অভিমুখে ছুটেছিলো। আমিও জনতার ঢলে সেদিন শরিক হয়েছিলাম। বিশেষ করে টাঙ্গাইলে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে স্বাধীন টাঙ্গাইলের প্রতিটি মুহুর্তই আমার দেখার সুযোগ হয়েছিলো এই বিদ্যালয়ের মাঠে। তাছাড়া এই বিদ্যালয় মাঠে বাঁশের আঁড়ে সারি সারি দাঁড়া করানো হাজার হাজার অস্র ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিলো সে সময়।


এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন জেলার খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাঁরা দেশ ও জাতীর জন্যে অবদান রেখে গিয়েছেন। এছাড়া সমাজসেবক, আইনজীবী , দার্শনিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। এইসব ব্যাক্তিবর্গ সে সময় বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং এখনো অনেকে আছেন। হয়তো সময় ও সুযোগের কারণে এই বিদ্যালয়টিকে নিয়ে তাঁরা চিন্তা ভাবনা করতে পারেননি। তবে একেবারেই না বলে পারা যায় না। বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন যাঁরা এক সময় মন্ত্রীও ছিলেন এবং অনেকে জীবিতও আছেন। বিদ্যালয়টির ব্যাপারে তাঁদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ ছিলো অনেক আগেই।
আমাদের টাঙ্গাইলবাসীর জন্যে দুটি গৌরবময় দিন যার একটি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ঐতিহাসিক কাগমারী সন্মেলন আরেকটি বিন্দু বাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সে সময়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদতলে বঙ্গবীর মো: আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর অস্র সমর্পণ। দুটি গৌরবগাঁথা ইতিহাসের কোনোটিকেই উপযুক্ত স্থানে অধিষ্ঠিত করার নূন্যতম প্রচেষ্টা করা হয়েছিলো কিনা জানি না। অথচ স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান, মেহেরপুরের আমবাগানে মুজিবনগর পার্ক ও কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের পরেই আমাদের টাঙ্গাইল জেলার এই স্থান দুটো ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ । অনেক আগেই এ গৌরবগাঁথা স্থানগুলোতে জাদুঘর ও স্মৃতিপার্ক স্থাপন করা যেতো। আজ মওলানা ভাসানীর সন্তোষে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। যদিও তিনি চেয়েছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় করার। এখানে দেশ বিদেশের কতো শিক্ষার্থীরা আসছেন কিন্তু তারা সেই গৌরবগাঁথা দিনগুলোর ব্যাপারে কতোটুকুই বা জানতে পারছেন! ঠিক তেমনি সেদিন এই বিদ্যালয়ের মাঠে পাক হানাদারদের সাথে যুদ্ধে করে ছিনিয়ে আনা হাজার হাজার অস্র বঙ্গবন্ধুর পদতলে বিছিয়ে দিয়েছিলেন সেই দিনগুলোর কথাই আজকের এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই বা কতোটুকু জানেন?

 প্রতিদিন এই শহরে দেশী বিদেশীসহ কতো মানুষের আগমন ঘটছে অথচ তাঁরা আমাদের এই গৌরবগাঁথা দিনগুলোর কথা কিছুই জানতে পারছেন না। আমি একটু আক্ষেপের সাথেই বলছি যখন বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন ভেঙ্গে নূতন করে ভবন নির্মাণের চিন্তা করা হয়েছিলো তখনি বাঁধাদান করা উচিৎ ছিলো এবং বলা উচিৎ ছিলো - এই এখানে হচ্ছেটা কি? তাঁদের চোখের সামনে দিয়ে এ ভাবে খন্ড খন্ড বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ মোটেই ঠিক হয়নি। যাঁরা বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের নকশা ও আর্থিক অনুমোদন দিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁরা হয়তো অন্য জেলার মানুষ ছিলেন তাই তাঁদের মাথায় আসেনি যে এটা আর দশটা বিদ্যালয়ের মতো নয় এটা একটা স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা প্রতিষ্ঠান! এই বিদ্যালয়টি হতে পারতো একক একটি ভবনের মধ্যে। যা এল প্যাটার্ন অথবা ইউ প্যাটার্ন একটি ভবন হওয়া উচিৎ ছিলো। যেখানে টাঙ্গাইল জেলা তথা সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি যাদুঘর ও স্মৃতিপার্ক থাকা উচিৎ ছিলো।


বিশাল টেরাকোটায় আনা যেতো সেইসব মুহুর্তগুলো। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধসহ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ইতিহাস। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ইতিহাস জানতো যুগ হতে যুগান্তরে।
স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা সম্বলিত এই বিদ্যালয়টিকে অস্তিত্বহীন অবস্থায় দেখতে চাই না আমরা টাঙ্গাইলবাসী। আমি এই গ্রুপের একজন নগন্য সদস্য। কখনও এই গ্রুপের অনেকের লেখায় লাইক বা কমেন্ট করি। আবার কখনো আমিও ভালো এটকা কিছু লেখার চেষ্টা করি। কতোটুকু ভালো দিকগুলো নিয়ে লিখি জানি না। যাইহোক, আমি টাঙ্গাইল সিটিজেন জার্নালিস্ট গ্রুপকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হবার আহবান করছি। এখন কথা বলার কতো সহজ প্লাটফরম তৈরি হয়েছে। আপনারা প্রতিনিয়ত সাক্ষাত পাচ্ছেন জেলার প্রসাশক, পুলিশ প্রসাশন, মেয়র, সাংসদ ও মন্ত্রী মহোদয়গনের। আপনারাই পারেন সম্মিলিত ভাবে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্য মহদয়ের মাধ্যমে প্রস্তাব উত্থাপন করতে। 

এ ব্যাপারে আমাদের জেলার প্রাক্তন ও বর্তমান মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মাননীয় পৌর মেয়র, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সুশিল সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষজনকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি আমাদের ইচ্ছাকে পূরণ করতে না পারি তবে এই গৌরবগাঁথা দিনগুলোর ইতিহাস অতল গহবরে হারিয়ে যাবে চিরতরে।
বি: দ্র: লেখা ও তথ্যে কোনো ভুলভ্রান্তি ও লেখায় কারও মনে আঘাতজনিত হয়ে থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশাকরি।

ঢাকা।
তারিখ : ১৫/০৫/২০১৯ ইং

R @ S. Theme images by PLAINVIEW. Powered by Blogger.